Breaking News

বিদেশে ক্যারিয়ার গড়তে চান? মালয়েশিয়া ও দুবাইতে চাকরির আদ্যপান্ত ও আবেদন প্রক্রিয়া

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থী এবং সদ্য গ্রাজুয়েটদের মধ্যে বিদেশে ক্যারিয়ার গড়ার প্রবণতা অনেক বেশি। পড়াশোনা শেষ করে অথবা পড়াশোনাকালীন পার্ট-টাইম বা ফুল-টাইম কাজের সুযোগের জন্য অনেকেই দেশের বাইরে পাড়ি জমাতে চান। আর এই তালিকায় এশিয়ার মধ্যে মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই (সংযুক্ত আরব আমিরাত) অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য।

কিন্তু সঠিক তথ্যের অভাবে অনেকেই ভুল পথে পা বাড়ান এবং প্রতারণার শিকার হন। আজকের এই ব্লগে আমরা আলোচনা করব—একজন শিক্ষার্থী বা চাকরিপ্রার্থী হিসেবে আপনি কীভাবে মালয়েশিয়া এবং দুবাইতে চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেবেন এবং সঠিকভাবে আবেদন করবেন।

কেন মালয়েশিয়া এবং দুবাই শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ?

চাকরি খোঁজার আগে গন্তব্য সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি।

১. দুবাই (UAE): দুবাই হলো মধ্যপ্রাচ্যের বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এখানে হসপিটালিটি, সেলস, রিয়েল এস্টেট এবং আইটি সেক্টরে প্রচুর কাজের সুযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো—এখানে ইনকাম ট্যাক্স বা আয়কর নেই। ইংরেজি ভাষায় ভালো দক্ষতা থাকলে দুবাইতে দ্রুত উন্নতি করা সম্ভব।

২. মালয়েশিয়া: এশিয়ার অন্যতম উন্নত এই দেশটিতে ম্যানুফ্যাকচারিং, কনস্ট্রাকশন এবং সার্ভিস সেক্টরে প্রচুর কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে শিক্ষিত তরুণদের জন্য আইটি, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং হোটেল ম্যানেজমেন্টেও ভালো সুযোগ রয়েছে। এখানকার আবহাওয়া এবং খাদ্যাভ্যাস আমাদের দেশের সাথে অনেকটা মানানসই।

ধাপ ১: নিজেকে প্রস্তুত করা (Preparation)

বিদেশে আবেদন করার আগে আপনার “ঝুড়ি” খালি থাকলে চলবে না। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আপনাকে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তুতি নিতে হবে।

  • পাসপোর্ট: সবার আগে অন্তত ১ বছরের মেয়াদসহ একটি পাসপোর্ট তৈরি রাখুন।
  • ভাষা দক্ষতা: দুবাইয়ের জন্য ইংরেজি জানাটা বাধ্যতামূলক। মালয়েশিয়ার জন্য ইংরেজি জানলে ভালো, তবে সামান্য মালয় ভাষা শিখে নিলে কর্মক্ষেত্রে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়।
  • কারিগরি দক্ষতা (Skills): কেবল “আমি বিদেশ যেতে চাই”—এটুকু যথেষ্ট নয়। আপনার কি কোনো বিশেষ দক্ষতা আছে? যেমন—গ্রাফিক ডিজাইন, ইলেকট্রিক্যাল কাজ, ড্রাইভিং, বা হোটেল ম্যানেজমেন্ট? দক্ষতা থাকলে বেতন এবং পদমর্যাদা দুটোই ভালো পাওয়া যায়।

ধাপ ২: প্রফেশনাল সিভি (CV) ও কভার লেটার তৈরি

বিদেশের চাকরির বাজারে আপনার মুখ বা চেহারা কেউ দেখবে না, দেখবে আপনার সিভি। বাংলাদেশের সাধারণ বায়োডাটা ফরম্যাট আন্তর্জাতিক বাজারে চলে না।

  • ইউরোপাস (Europass) বা আন্তর্জাতিক ফরম্যাট: আপনার সিভিটি অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে।
  • স্পষ্ট তথ্য: আপনার শিক্ষা, কাজের অভিজ্ঞতা (যদি থাকে) এবং স্কিলগুলো পয়েন্ট আকারে লিখুন।
  • ছবি: একটি প্রফেশনাল ছবি সিভিতে যুক্ত করুন। সেলফি বা ক্যাজুয়াল ছবি ব্যবহার করবেন না।

উদাহরণ: ধরুন আপনি দুবাইতে একটি শপিং মলে সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে আবেদন করবেন। আপনার সিভিতে উল্লেখ করুন আপনার কমিউনিকেশন স্কিল কেমন এবং আপনি চাপে কাজ করতে পারেন কিনা।

ধাপ ৩: চাকরির খোঁজ ও আবেদন প্রক্রিয়া

এখন প্রশ্ন হলো, চাকরি খুঁজবেন কোথায়? দালালের খপ্পরে না পড়ে প্রযুক্তির ব্যবহার শিখুন।

ক. অনলাইন জব পোর্টাল (সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম)

বর্তমানে লিংকডইন (LinkedIn) এবং অন্যান্য জব সাইটগুলো বিদেশে চাকরির জন্য সেরা মাধ্যম।

  • দুবাইয়ের জন্য: Bayt.com, Naukrigulf, Dubizzle, LinkedIn.
  • মালয়েশিয়ার জন্য: JobStreet, WOBB, LinkedIn.

আবেদনের নিয়ম:
১. এই সাইটগুলোতে একটি প্রফেশনাল প্রোফাইল তৈরি করুন।
২. আপনার সিভি আপলোড করুন।
৩. সার্চ অপশনে গিয়ে আপনার পছন্দমতো চাকরি (যেমন: “Waiter”, “Junior Accountant”, “IT Support”) লিখে সার্চ দিন।
৪. সরাসরি কোম্পানির এইচ আর (HR) বা নিয়োগকারী এজেন্সির কাছে মেইল বা পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন করুন।

খ. সরকারি মাধ্যম (BOESL)

বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) এর মাধ্যমে সরকারিভাবে নিয়মিত স্বল্প খরচে কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের ওয়েবসাইট (boesl.gov.bd) এবং ফেসবুক পেজে নিয়মিত নজর রাখুন। জর্ডান, দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়াও মাঝে মাঝে তারা মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়।

গ. রিক্রুটিং এজেন্সি

যদি আপনি এজেন্সির মাধ্যমে যেতে চান, তবে অবশ্যই যাচাই-বাছাই করতে হবে। সরকার অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির একটি তালিকা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (BMET) এর ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। এজেন্সির বৈধ লাইসেন্স (RL Number) আছে কিনা তা দেখে নিন।

ধাপ ৪: ভিসা প্রসেসিং ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র

চাকরি নিশ্চিত হওয়ার পর বা “অফার লেটার” পাওয়ার পর ভিসার কাজ শুরু হয়।

মালয়েশিয়া:
মালয়েশিয়ায় সাধারণত নিয়োগকর্তা (Employer) আপনার জন্য কলিং ভিসার ব্যবস্থা করেন। আপনাকে মেডিকেল (GAMCA) করতে হবে এবং পরবর্তীতে ই-ভিসা প্রসেস করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য “স্টুডেন্ট ভিসা” নিয়ে গিয়ে সেখানে পার্ট-টাইম কাজ করার নিয়মটি বেশ জটিল এবং সীমিত, তাই “এমপ্লয়মেন্ট ভিসা” বা ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

দুবাই:
দুবাইতে ভিজিট ভিসায় গিয়েও অনেকে কাজ খোঁজেন। তবে এটি ঝুঁকিপূর্ণ। সঠিক নিয়ম হলো—দেশ থেকে “এমপ্লয়মেন্ট ভিসা” নিশ্চিত করে যাওয়া। কোম্পানি আপনাকে অফার লেটার পাঠাবে, যার ভিত্তিতে এন্ট্রি পারমিট ইস্যু হবে।

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:

  • পাসপোর্ট (মূল কপি ও ফটোকপি)।
  • শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ (সত্যায়িত)।
  • পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট।
  • মেডিকেল রিপোর্ট।
  • চাকরির অফার লেটার বা চুক্তিপত্র।

সাবধান! প্রতারণা থেকে বাঁচার উপায়

শিক্ষার্থীরা প্রায়ই আবেগের বশবর্তী হয়ে দালালদের হাতে টাকা তুলে দেন। নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখুন:

১. টাকা লেনদেন: কোনো প্রকার ওয়ার্ক পারমিট বা ভিসা হাতে পাওয়ার আগে কাউকে টাকা দেবেন না। ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে লেনদেন করা সবচেয়ে নিরাপদ।
২. ফ্রি ভিসা: “ফ্রি ভিসা” বা “আজাদ ভিসা” বলে কোনো আইনি শব্দ নেই। এটি একটি ধোঁকাবাজি। নির্দিষ্ট কোম্পানির স্পন্সরশিপ ছাড়া বিদেশে কাজ করা অবৈধ।
৩. বেতন ও সুযোগ-সুবিধা: অফার লেটারে আপনার বেতন, ডিউটি সময়, ওভারটাইম এবং থাকার ব্যবস্থা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে লেখা আছে কিনা তা পড়ে সই করবেন।

উদাহরণ: রফিক একজন শিক্ষার্থী। তাকে এক দালাল বলল, “৩ লক্ষ টাকা দাও, দুবাইতে গিয়ে ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারবে।” রফিক টাকা দিয়ে দুবাই গিয়ে দেখল তার কোনো লিগ্যাল কাজ নেই এবং পুলিশ তাকে খুঁজছে। এই পরিস্থিতি এড়াতে নির্দিষ্ট কোম্পানির নাম ছাড়া ভিসা গ্রহণ করবেন না।

শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ পরামর্শ

১. কাজের অভিজ্ঞতা: পড়াশোনার পাশাপাশি দেশে ছোটখাটো কোনো কাজ বা ইন্টার্নশিপ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করুন। ফ্রেশারদের চেয়ে অভিজ্ঞদের বিদেশে চাহিদা বেশি।
২. কম্পিউটার স্কিল: এমএস অফিস, এক্সেল এবং ইমেইল কমিউনিকেশন জানা থাকলে অফিসিয়াল জবের সুযোগ পাওয়া সহজ হয়।
৩. নেটওয়ার্কিং: বিদেশে থাকা পরিচিত আত্মীয় বা বড় ভাইদের সাথে যোগাযোগ রাখুন। তাদের রেফারেন্সে অনেক সময় ভালো চাকরি পাওয়া যায়।

পরিশেষে

মালয়েশিয়া বা দুবাইতে ক্যারিয়ার গড়া অসম্ভব কিছু নয়, তবে এর জন্য প্রয়োজন ধৈর্য এবং সঠিক পরিকল্পনা। আবেগের বশবর্তী হয়ে দালালকে টাকা না দিয়ে, নিজের দক্ষতা উন্নয়নে মন দিন এবং অনলাইন পোর্টালগুলো ব্যবহার করে সরাসরি আবেদন করার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, একটি সঠিক সিদ্ধান্ত আপনার এবং আপনার পরিবারের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে।

শুভকামনা আপনার আগামীর জন্য!


সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)

১. স্টুডেন্ট ভিসায় গিয়ে কি মালয়েশিয়া বা দুবাইতে ফুল-টাইম কাজ করা যায়?
উ: সাধারণত স্টুডেন্ট ভিসায় ফুল-টাইম কাজ করা অবৈধ। তবে সেমিস্টার ব্রেক বা নির্দিষ্ট কিছু শর্তে সীমিত সময়ের জন্য পার্ট-টাইম কাজ করার অনুমতি থাকতে পারে। স্থায়ী আয়ের জন্য ওয়ার্ক পারমিট নেওয়াই শ্রেয়।

২. দুবাইতে যেতে কত টাকা লাগে?
উ: এটি নির্ভর করে আপনি কোন ভিসায় যাচ্ছেন এবং কোম্পানি খরচ বহন করছে কিনা। ভালো কোম্পানি হলে বিমান ভাড়াসহ সব খরচ তারাই বহন করে। এজেন্সির মাধ্যমে গেলে ৩-৪ লক্ষ টাকা বা তার বেশি লাগতে পারে।

৩. পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট কেন লাগে?
উ: আপনার নামে দেশে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই—এটি প্রমাণ করার জন্য এবং বিদেশে আপনার স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্য এটি বাধ্যতামূলক।

Check Also

ডিসেম্বর সকল চাকুরী একসাথে-2025

ডিসেম্বর ২০২৫—চলমান সরকারি চাকরির আপডেট (সর্বশেষ)

ডিসেম্বর ২০২৫ মাসে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় বেশ কিছু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি …

Leave a Reply